ইসলামী পরিভাষায় :
দুই রাকাত সালাত ও বিশেষ দুয়ার মাধ্যমে আল্লাহর তায়ালার
নিকট দুটি বিষয়ের মধ্যে কল্যাণকর বিষয়ে মন ধাবিত হওয়ার জন্য আশা করা। অর্থাৎ দুটি বিষয়ের
মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর হবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট দু রাকাত সালাত ও ইস্তিখারার
দুয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার নামই ইস্তেখারা। [ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল
বুখারী]
ইস্তেখারা করার হুকুম :
এটি সুন্নাত। যা সহীহ বুখারীর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
তবে কেউ কেউ নফল ও বলেছেন।
ইস্তেখারা কখন করতে হয়?
মানুষ বিভিন্ন সময় একাধিক বিষয়ের মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কারণ, কোথায় তার কল্যাণ নিহিত আছে সে ব্যাপারে কারো জ্ঞান নেই। তাই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য মহান আল্লাহর তাআলার পক্ষ থেকে উক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। যেন তিনি সিদ্ধান্তকে এমন জিনিসের উপর স্থির করে দেন যা তার জন্য উপকারী ও কল্যাণকর হয়।
এই নামাযের নির্দিষ্ট সময় নেই। সাধারণ নফলের হুকুমেই পড়ে এটি।
যেমন: বিয়ে, চাকরী, সফর ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তেখারা করতে হয়।
ইস্তেখারা করা কত টুকু সঠিক? শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন:
“সে ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না যে স্রষ্টার নিকট ইস্তেখারা করে এবং মানুষের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল থাকে।”
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরামর্শ কর। অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদের পছন্দ করেন।“ [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]
কাতাদা(রহঃ) বলেন:
“মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তাওফীক দেন।”
ইমাম নববী রহ. বলেন:
“আল্লাহ তায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভাল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরিমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দুর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়।”
ইস্তেখারা করার নিয়ম:
১) প্রথমে ওযু করতে হবে।
২) ইস্তিখারার উদ্দেশ্যে দু রাকাত সালাত পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে কতক ওলামায়ে কেরাম প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস পড়তেন। তবে যে কোন সূরা পড়া যাবে।
৩) নামাযের সালাম ফিরিয়ে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব, ও মর্যাদার কথা মনে জাগ্রত করে একান্ত বিনয় ও নম্রতা সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দুরূদ পেশ করার পর নিচের দুয়াটি পাঠ করবে:
اللَّهُمَّ إنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ , وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ , وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلا أَقْدِرُ , وَتَعْلَمُ وَلا أَعْلَمُ , وَأَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ (………) خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي) أَوْقَالَ : عَاجِلِأَمْرِيوَآجِلِهِ) فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ , اللَّهُمَّ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ(………) شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي (أَوْقَالَ : عَاجِلِأَمْرِيوَآجِلِهِ) فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ ارْضِنِي بِهِ (……).
এ দুআর যেখানে “হাজাল আমর” অথবা (………) এরকম দেয়া আছে ওখানে পৌঁছে মনে মনে যে কাজটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে সেটি উচ্চারণ করবে আরবীতে বা মনে মনে সে বিষয়টি ভেবে নিবে।
ইস্তেখারার নামাযের দলিল-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَلِّمُنَا الاِسْتِخَارَةَ فِي الأُمُورِ كُلِّهَا كَمَا يُعَلِّمُنَا السُّورَةَ مِنَ القُرْآنِ، يَقُولُ: إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالأَمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الفَرِيضَةِ، ثُمَّ لِيَقُلْ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلاَّمُ الغُيُوبِ، اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعِيشَتِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي، أَوْ قَالَ: فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ، فَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعِيشَتِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي، أَوْ قَالَ: فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ، فَاصْرِفْهُ عَنِّي، وَاصْرِفْنِي عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِي الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِي بِهِ، قَالَ: وَيُسَمِّي حَاجَتَهُ. (سننر الترمذى، رقم الحديث-480
হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা:) প্রত্যেক কাজে আমাদের ইস্তেখারা করা সম্পর্কে এমন ভাবে শিক্ষা দিতেন যেভাবে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোন কাজ করার করবে তখন সে দু’ রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, এরপর সে এই দুয়াটি পাঠ করবে।
এটা বলে উপরের দুয়াটি বর্ণনা করেন। ভাল মন্দের ফায়সালা কিভাবে হবে?
নামাজ শেষ করে কারো সাথে কথা না বলে কিবলামুখী হয়ে
ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম থেকে জাগার পর মন যেদিকে সায় দিবে, বা যেদিকে আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটিই
ফলাফল মনে করবে। [তুহফাতুল আলমায়ী-২/৩৩৮, বেহেশতী জেওর]
এটি একটি কমন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রাসুল (সাঃ) আনাস (রাঃ) কে বলেছেন: সাত বার অর্থাৎ পর পর সাতদিন ইস্তিখারা করে মনের গতি ও ঝোঁক যে দিকে যায় তার সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ অনেক সময় সরাসরি কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়না। তাই না জানার কারণে কনফিউশন থেকে যায়। তাই বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করতে এবং আরো কার্যকর হিসেবে গ্রহণ করতে কিছু টিপস উল্লেখ করলাম। যারা বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত ইস্তিখারা করে সুফল ভোগ করেছেন তাদের সাথে একান্তে আলাপে যা জানা গেল তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করলাম:
- আপনি যে বিষয়ে ভাবছেন আপনি স্বপ্নে হুবহু সে বিষয়ের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন কিংবা তা বর্জনমূলক কাজ দেখতে পাবেন এবং এটি সরাসরি আপনার সিদ্ধান্তেই। (এটি হচ্ছে ইস্তিখারার সর্বোচ্চ রেজাল্ট)।
- অথবা আপনি যা ভাবছেন সে বিষয়ে স্বপ্নে আপনার পরিবারের সদস্যদের কিছু ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কাজ দেখতে পাবেন।
- অথবা স্বপ্নে কিছু দেখবেননা কিন্তু আপনার মন যত দিন যায় তত বিষয়টির দিকে ঝোঁকতে থাকে কিংবা তার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হতে থাকে।
- অথবা এ ব্যপারে আপনার মন স্বাভাবিক এবং নেতিবাচক কিছু আসছেনা। তাহলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
- কেউ প্রথম রাতেই রেজাল্ট পেয়ে যান এবং পরে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। আবার কারো বিলম্বও হয়ে থাকে।
- আল্লাহ্র সাথে আপনার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আপনি আরও উচ্চ মানের রেজাল্ট ও পেতে পারেন।
- আল্লাহ্র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও ভরসা রেখে ইস্তিখারা করতে হবে।
- পর পর ন্যুনতম সাত দিন ইস্তিখারা করতে হবে।
- ইস্তিখারার রেজাল্টের জন্য ধৈয্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে। আল্লাহ্ আপনাকে সহযোগিতা করবেন এটা মনে রাখলে আরো সহজ হবে।
- ইস্তিখারা করার সময় আপনার বিষয়ে আপনাকে নিউট্রেল হতে হবে এই অর্থে যে আপনি যা রেজাল্ট পাবেন সে অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা রাখেন এবং এর মধ্যেই কল্যাণ মনে করেন।
- ইস্তিখারার রেজাল্ট পেতে বিলম্ব হলে রেজাল্ট পাবেননা এমনটা ভেবে নিরাশ হওয়া যাবেনা।
- ইস্তিখারার রেজাল্ট পেলে বিশেষ ব্যক্তি কিংবা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্যের কাছে বলা ঠিক নয়। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহ্র উপর আপনার তাওয়াক্কুল বাড়ছে এবং ধীরে ধীরে আল্লাহ্র সাথে আপনার সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে। আর তাই এমন গোপন বিষয়টা অহেতুক ফাঁস করলে আপনার ইবাদতের মান কমে যাবে এবং নিজের ব্যপারে উচ্চ ধারণা হেতু অহংকার প্রকাশের সম্বাবনা আছে। তাছাড়া এটি আপনার কাজের জন্য দৃঢ় একটি সমর্থক এবং আপনার মনোবলকে দৃঢ় করতে সহকারী। কিন্তু অন্য মানুষের জন্য এটি অকাট্য কিছু নয়। তবে তাদের কাছেই বলবেন যারা আপনাকে জানেন এবং বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আপনাকে আপনার উদ্দৃষ্ট কাজে সহযোগিতা করতে পারেন।
- নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি রেজাল্ট না পাওয়া যায় তাহলে আল্লাহ্ আপনাকে দিতে পারেন এই ধারণাকে আরো প্রবল করে কিছু দিন পর একই নিয়মে আবার চেষ্টা করুন। ইনশা আল্লাহ্ আপনি নিরাশ হবেননা।
- আসলে ইস্তিখারার বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্র সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই হয়ে থাকে। বিষয়টি আল্লাহ্র সাথে একান্ত আপনার নিজের। তাই পূর্ণ স্কেলে পরিমাপ আপনিই করতে পারবেন। তবে আল্লাহ্র সাথে আপনার বর্তমান সম্পর্ক বেশী ভালো নয় এটা ভেবে ইস্তিখারা থেকে দূরে থাকলে আপনি অপসিদ্ধান্তে ভোগবেন। তাই ইস্তিখারার মাধ্যমেই আল্লাহ্র সাথে আপনার সম্পর্ক সৃষ্টি করুন এবং পরিমাপ করুন।
- আপনার ঈমান, বর্তমান তাওয়াক্কুল এবং আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে খুব কম সময়ে খুব স্পষ্ট রেজাল্ট কিংবা কিছু বিলম্বে তুলনামূলক কম স্পষ্ট রেজাল্ট পাবেন। এজন্য প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এতেই আপনার কল্যান নিহিত।
- আপনি যদি একবার ইস্তিখারা রেজাল্ট পান তাহলেই আপনি এর স্বাদ আস্বাদন করবেন এবং এর পর যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজেই ইস্তিখারা করতে আপনার মন চাইবে।
- ইস্তিখারার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে বান্দার সম্পর্ক নিবিড় হয় এবং ঈমান ও তাওয়াক্কুল বেড়ে যায়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন: “মুমিন ব্যক্তিদের আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা উচিৎ”।[১৪:১২] তিনি আরো বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট।[৬৫:৩]
- এই ইস্তিখারার সুফল একে বারেই নিশ্চিত। শুধু গ্যারান্টির জন্য প্রয়োজন আপনার প্র্যাকটিস।
আপনার সিদ্ধান্ত:
আসুন! আমরা মহান আল্লাহ্র কাছে আমাদের প্রয়োজন মেটাতে একটু ধরনা দেই। আমাদের নিজেদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ্র কাছে ইস্তিখারা করতে শিখি এবং ইস্তিখারার মাধ্যমে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও টার্নিং পয়েন্টগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের গচ্ছিত কল্যাণ হাসিল করতে উদ্যত হই। দু’একটি ইস্তিখারার সুফল পেয়ে এর নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তুলি। এর মধ্যেই মহান আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় ও কল্যাণ নির্ধারন করে রেখেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে ইস্তিখারা করার জন্য মানসিকতা ও তাওফীক দান করুন। আমীন!!
আবু তালিব মোহাম্মাদ মোনাওয়ার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন